অস্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণে আরও কঠোর হচ্ছে সরকার

বিএনপি-জামায়াত জোটের হরতাল-অবরোধের নামে অরাজকতা সৃষ্টি ও সহিংসতার বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে আরো কঠোর হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। চলতি মাসের ১৪ নভেম্বর এ তফসিল ঘোষণার সম্ভাবনা রয়েছে।

এদিকে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চলমান সংকট কাটাতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন দিক থেকে সব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার কথা বলা হচ্ছে। সব পক্ষকে শর্তহীন আলোচনায় বসার কথাও বলা হচ্ছে। তবে বিএনপির আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত কয়েকদিনের সহিংসতা ও বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহে এখন শর্তহীন আলোচনাও করতে চায় না সরকার।

আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপি তিনদিনের অবরোধের পর আগামী রোববার থেকে আবারও দুদিনের অবরোধ ঘোষণা দিয়েছে।

এদিকে যে দাবিতে বিএনপি আন্দোলন করছে সেই দাবি আওয়ামী লীগও মানবে না এবং সংবিধান অনুযায়ীই আগামী নির্বাচন হবে এটা অনেক আগেই স্পষ্ট করেছে দলটি। আদালতের রায়ে বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক যাতে আর ফিরে না আসতে পারে সে বিষয়েও কঠোর অবস্থান নিয়েছে দলটি।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, আগামী ১৪ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এদিন না হলে পরদিন ১৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণা করা হবে। তবে ১৪ নভেম্বর সম্ভাবনা বেশি বলে সূত্রগুলো জানায়। এ তফসিল ঘোষণার পর সরকারের অবস্থান আরও পাল্টে যাবে। যেকোনো মূল্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থানে যাবে। তফসিল ঘোষণার পর ইসি একটি আচরণবিধিও প্রকাশ করবে। সেই আরচণবিধি অনুযায়ী সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে যে যে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন হবে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো সেই পদক্ষেপ নেবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে ওই সূত্রগুলো জানায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপি এর আগেও অবরোধ দিয়েছিল। ৯৩ দিন চালিয়েছে। পরে প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। আগামী নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী ও যথাসময়েই হবে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আচরণবিধি হবে। সবদলকেই সেটা মেনে চলতে হবে। সরকার ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব নির্বাচনী আচরণবিধি অনুসরণ করা। এটা সাংবিধানিক দায়িত্ব। তখন সরকারের দায়িত্ব হবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, স্বাভাবিক রাখা ও সে ব্যবস্থা সরকার নেবে।

এদিকে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপিরসহ আন্দোলনরত দলগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন সময় আলোচনার কথা এসেছে। সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আলোচনার কথা বার বার নাকচ করেছে আওয়ামী লীগ। তবে শর্তহীন আলোচনার বিষয়ে দলটির কিছুটা নমনীয়তা ছিল। শর্ত দিয়ে কোনো আলোচনা হয় না, দলটির নেতারা এমন কথাও বলেছেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপির সঙ্গে শর্তহীন আলোচনায়ও যাবে না আওয়ামী লীগ। যেটি দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে। গত ২ নভেম্বর জাতীয় সংসদের সর্বশেষ অধিবেশনে দেওয়া বক্তব্যে তিনি সংলাপ জোরালোভাবে নাকচ করেছেন।

গত ৩১ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাতের পর ব্রিফিংয়ে উত্তেজনা প্রশমন এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথ খুঁজে বের করতে সব পক্ষ কোনো পূর্বশর্ত ছাড়াই সংলাপে অংশ নেবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন। গত ২ নভেম্বর সংসদের বিরোধীদল জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সংসদে দেয়া বক্তব্যে রাজনৈতিক সংকট সমাধানে সবদলের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানান। এসময় তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকেও শর্তহীনভাবে আলোচনায় আসার আহ্বান জানান।

সরকার ও আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, সরকার উৎখাত করতে বিএনপি একদফা দাবিতে আন্দোলনের নামে দেশকে অশান্ত করতে নাশকতা, সহিংসতার পথ বেছে নিয়েছে বলে সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন। ইতোমধ্যেই সহিংসতা ঘটিয়ে দলটি সেটা প্রমাণ করেছে এবং এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটাবে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।

গত ২৮ অক্টোবর একজন পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, ওইদিনের ঘটনায় একজন সাংবাদিকও প্রাণ হারিয়েছেন। এরপর দলটি অবরোধ কর্মসূচি দিয়ে পুরোনো আগুন সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে। এসব ঘটনায় ইতোমধ্যে কয়েকজনের প্রাণ গেছে। আর এসব ঘটনার পর বিশেষ করে ২৮ অক্টোবরের পর বিএনপির সঙ্গে শর্তহীন সংলাপেরও সুযোগ নেই। সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা এসব সহিংসতা, নাশকতা কঠোর অবস্থানে থেকে রাজপথেই প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে ওই সূত্রগুলো জানায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি দলের নেতাকর্মীদেরও মাঠে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

শুক্রবার (৩ নভেম্বর) জেলহত্যা দিবসে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিএনপিকে কঠোর হুঁশিয়ারির পাশাপাশি নিজ দলের নেতাকর্মীদেরও প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেছেন, যেখানে যেখানে তারা এ ধরনের অগ্নিসন্ত্রাস করবে সেই এলাকায় কতজন বিএনপি-জামায়াতের দুর্বৃত্ত আছে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। ওগুলোকে ধরিয়ে দিতে হবে। অবরোধ আর অগ্নিসন্ত্রাস করে একটাও যেন পার না পায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, ২৮ অক্টোবর যে ঘটনা বিএনপি ঘটিয়েছে এরপর আর কোনো শর্তহীন আলোচনারও সুযোগ নেই, থাকে না। যে পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, তার কী হবে। তার পরিবারকে কী বলবেন। আমি তো বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের বলেছি তারা কেন সংলাপের কথা বলে, বিষয়টি কী তাদের? যাদের বিষয় তারা (বিএনপি) কিন্তু বলেনি। এখন কোনো সংলাপ হবে না, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে যে দলগুলো আসবে, সেগুলো নিয়েই নির্বাচন হবে।

আরও পড়ুন