পবিত্র আশুরার আমল ও মুসলিমদের করণীয়

বুধবার (১৭ জুলাই) পবিত্র আশুরা পালিত হবে। পবিত্র আশুরা বা মহররম মাসের ১০ তারিখ ইসলামের ইতিহাসে এ দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পবিত্র আশুরার এ দিনে ইসলামের ইতিহাসে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। নিচে কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা তুলে ধরা হলো :আশুরার দিন আল্লাহতাআলা মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের অত্যাচার থেকে মুক্ত করেছিলেন। মুসা (আ.)-এর দোয়ায় আল্লাহতাআলা রেড সি বা লোহিত সাগরকে বিভক্ত করে দিয়েছিলেন এবং মুসা (আ.) ও তার অনুসারীরা নিরাপদে পার হতে পেরেছিলেন কিন্তু ফেরাউন ও তার বাহিনী ডুবে যায়।নবী নূহ (আ.)-এর কিস্তি ৪০ দিন ও ৪০ রাতের বন্যার পর জুদি পর্বতে অবতরণ করেছিল আশুরার এই দিনে। এ ঘটনাটি আল্লাহর রহমত এবং নবী নূহ (আ.)-এর ধৈর্যের উদাহরণ হিসেবে উল্লিখিত।

পবিত্র আশুরার দিন আল্লাহতাআলা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে রক্ষা করেছিলেন। আল্লাহর আদেশে আগুন ঠান্ডা হয়ে ইব্রাহিম (আ.)-এর জন্য শান্তি হয়ে যায়।

হজরত ঈসা (আ.)-কে পবিত্র আশুরার দিন আসমানে তুলে নেওয়া হয়েছিল বলে অনেক বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে। আশুরার দিনেই ৬১ হিজরিতে ইমাম হুসাইন (রা.) ও তার অনুসারীরা কারবালার ময়দানে ইয়াজিদের বাহিনীর হাতে শাহাদাত বরণ করেন। এ ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে।

ইসলাম ধর্মের বর্ণনামতে, কেয়ামতের দিন আশুরার দিন ঘটবে বলে হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। আশুরার দিনে আল্লাহতাআলা অনেক নবী ও তাদের অনুসারীদের বিভিন্ন বিপদ-আপদ থেকে মুক্তি দিয়েছেন। পবিত্র আশুরার দিনে আল্লাহতাআলা আদম (আ.)-এর তওবা কবুল করেছিলেন।

এ ঘটনাগুলো পবিত্র আশুরার দিনকে মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্ববহ এবং তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে।

পবিত্র আশুরা সম্পর্কে কিছু হাদিস ও বর্ণনা ১. রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা ওয়াজিব ছিল। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর এ দিন রোজা রাখা মুস্তাহাব। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, জাহেলি সমাজের লোকেরা রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার দিন রোজা রাখত। এ দিন কাবায় গিলাফ জড়ানো হতো। এরপর যখন রমজানের রোজা ফরজ হলো তখন নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যিনি এ দিন রোজা রাখতে চায় সে রাখুক। যিনি না চায় না রাখুক। (বুখারি : ১৫৯২)

৩. তওবা গুরুত্বপূর্ণ আমল। নবীজির এক সাহাবি জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রসুল! রমজানের পর আপনি কোন মাসে রোজা রাখতে বলেন? নবীজি বলেন, তুমি যদি রমজানের পর রোজা রাখতে চাও তাহলে মহররমে রোজা রাখো। কেননা মহররম হচ্ছে আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন এক দিন আছে, যেদিন মহান আল্লাহ অতীতে অনেকের তওবা কবুল করেছেন। ভবিষ্যতেও অনেকের তওবা কবুল করবেন। (তিরমিজি : ৭৪১)

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র আশুরার দিনে আমল ও ইবাদত

রাসুলুল্লাহ (সা.) পবিত্র আশুরার দিনে বিশেষ কিছু আমল এবং ইবাদত করেছেন, যা মুসলিম উম্মাহর জন্য অনুসরণীয়। নিচে কিছু উল্লেখযোগ্য কার্যকলাপ তুলে ধরা হলো।

রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পরে দেখলেন, মদিনার ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা রাখছে। তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা বললো, এই দিনে আল্লাহতাআলা মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের অত্যাচার থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। তাই আমরা এ দিন রোজা রাখি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমরা মুসার (আ.) সঙ্গে আরও বেশি সম্পৃক্ত। তাই তিনি নিজেও রোজা রাখলেন এবং সাহাবিদেরও রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। (সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম)

রাসুলুল্লাহ (সা.) আশুরার দিনে বেশি বেশি তওবা ও ইস্তিগফার করতেন। এই দিনে আল্লাহর কাছে নিজের গুনাহ মাফের জন্য দোয়া করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) আশুরার দিনে গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করতেন এবং তাদের প্রতি দান-খয়রাত করতেন। এই দিনে দান করলে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব। আশুরার দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর কাছে বিভিন্ন দোয়া করতেন এবং তার উম্মাহর জন্য কল্যাণ কামনা করতেন। পবিত্র আশুরার দিনে রাসুলুল্লাহ (সা.) আশুরার দিনে বেশি বেশি ইবাদত করতেন, কোরআন তেলাওয়াত করতেন, এবং নফল নামাজ আদায় করতেন।

পবিত্র আশুরার দিনে মুসলিমদের জন্য বিশেষ কিছু করণীয় রয়েছে, আশুরার দিনে কেবলমাত্র রোজা রাখা নয়, সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত নামাজ আদায় করা, বেশি বেশি তওবা-ইস্তিগফার করা এবং সৎ কাজ করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা উচিত। যা পালন করলে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব। নিচে এই দিনের করণীয় বিষয়গুলো তুলে ধরা হলো:

১. রোজা রাখা : আশুরার রোজা কবে রাখতে হয় এবং কয়টি রাখতে হয়?

বিভিন্ন হাদিসে আশুরার রোজার ফজিলত রয়েছে। হজরত আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মহান আল্লাহর কাছে আমি আশা পোষণ করি যে, তিনি আশুরার রোজার মাধ্যমে আগের এক বছরের পাপ ক্ষমা করে দেবেন। (তিরমিজি : ৭৫২)

বাংলাদেশে সোমবার (৮ জুলাই) থেকে মহররম মাস গণনা শুরু হয়। সে হিসেবে বুধবার (১৭ জুলাই) পালিত হবে পবিত্র আশুরা। পবিত্র আশুরার দুটি রোজা রাখতে হবে। এ হিসেবে মহররমের ১০ তারিখ বুধবার (১৭ জুলাই) একটি, আর এর আগে মহররমের ৯ তারিখ মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) অথবা পরের দিন মহররমের ১১ তারিখ বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) আরও একটি।

নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা আশুরার দিনে রোজা রাখো, তবে এ ক্ষেত্রে ইহুদিদের সঙ্গে মিল না হওয়ার জন্য মহররমের ১০ তারিখের আগের দিন অথবা পরের দিন আরও একটি রোজা রাখো। (মুসনাদে আহমদ: ২১৫৪)

২. ইবাদত ও দোয়া করা – নামাজ আদায় : পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি নফল নামাজ আদায় করা। – কোরআন তেলাওয়াত : বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করা। – দোয়া : নিজের এবং অন্য মুসলমানদের জন্য কল্যাণ কামনা করে দোয়া করা।

৩. তওবা ও ইস্তিগফার নিজের গুনাহের জন্য তওবা করা এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। সবার কর্তব্য এটির কদর করা। আশুরার দিন তওবা কবুলের মোক্ষম সময়। এদিনে তওবা কবুল হওয়া, নিরাপত্তা এবং অদৃশ্য সাহায্য লাভ করার কথাও রয়েছে। এ জন্য এ সময়ে এমন সব আমলের প্রতি মনোনিবেশ করা উচিত, যাতে মহান আল্লাহর রহমত বান্দার দিকে আরও বেশি ধাবিত হয়।

৪. সৎ কাজ করা ও সহায়তা করা এবং সদয় আচরণ করা। – সৎ কাজ : যে কোনো সৎ কাজ করা, যেমন মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা, মিথ্যা ও অন্যায় থেকে বিরত থাকা। – গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করা : আশুরার দিনে দান-খয়রাত করা এবং গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করা। – আত্মীয়স্বজনের সাথে সম্পর্ক রক্ষা : আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের প্রতি সদয় আচরণ করা।

৫. শিক্ষামূলক কার্যক্রম – শিক্ষাগ্রহণ : আশুরার দিনের তাৎপর্য এবং ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা। – পরিবারের সঙ্গে আলোচনা : পরিবারের সদস্যদের সাথে আশুরার দিনের তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা করা এবং তাদের এ দিনটি গুরুত্বের সঙ্গে পালনের জন্য উৎসাহিত করা।

৬. শোক পালন – কারবালার শহীদদের স্মরণ : হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) এবং তার সঙ্গীদের কারবালার ময়দানে শাহাদাত বরণের ঘটনা স্মরণ করা। তাদের ত্যাগের গুরুত্ব বোঝা এবং অনুভব করতে পারা।

আশুরার দিনটি পালনের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর কাছে আরও কাছাকাছি আসতে পারি এবং তার রহমত ও মাগফিরাত অর্জন করতে পারি। আশুরার দিনটি ইসলামের ইতিহাসে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন ও আমল থেকে আমরা অনেক কিছু শিখার রয়েছে। তা অনুসরণে আমরা এই দিনটি গুরুত্ব সহকারে পালন করতে পারি।

হজরত ইউনুস (আ.)-কে একটি বড় মাছ গিলে ফেলেছিল। ৪০ দিন সেই মাছের পেটে থাকার পর আল্লাহর আদেশে তাকে মুক্তি দিয়েছিলেন পবিত্র আশুরার এ দিনে।

আরও পড়ুন