হাসান মাহমুদ শাকিল: লক্ষ্মীপুরে জেঁকে বসেছে শীত। তীব্র ঠাণ্ডার সঙ্গে হিমেল হাওয়া জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। চলমান মৃদু শৈত্যপ্রবাহ ও তীব্র শীতে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছেন খেটেখাওয়া মানুষ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে আছে জেলার ভাসমান ‘মানতা’ সম্প্রদায়। মূলত মানতা সম্প্রদায়ের বসবাস নৌকায়।
মেঘনা নদীর হিমেল হাওয়ায় কাঁপছে পুরো সম্প্রদায়। পর্যাপ্ত শীতের কাপড়ের অভাবে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারছেন না তারা। শীতের তীব্রতা এত বেশি যে, ১২ দিন ধরে মাছ ধরতেও যেতে পারছেন না মানতারা।
বুধবার (৫ জানুয়ারি) বিকেলে সদর উপজেলার চররমনী মোহন ইউনিয়নের মজুচৌধুরীর হাট লঞ্চঘাট এলাকায় মানতা সম্প্রদায়ের ছয় জেলে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তাদের এ দুর্ভোগের কথা জানান।
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নৌকাতেই সংগ্রাম করে কাটে মানতা সম্প্রদায়ের মানুষের জীবন। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে তারা নৌকা থেকে অন্য কোথাও যান না। সম্প্রদায়টির পুরুষ সদস্যরা স্থানীয় হাট-বাজারে গেলেও নারীরা নৌকাতেই থাকেন।
কথা হয় মানতা সম্প্রদায়ের বকুল বেগম, সুখিয়া বেগম, আছমা আক্তার ও আবদুর রহিমসহ কয়েকজনের সঙ্গে। তারা জানান, কখনো জমিতে বসবাস করেননি তারা। জন্মের পর থেকেই নৌকাতে বসবাস করে আসছেন। ঘর-বাড়িতে বসবাস করার আনন্দও কখনও তারা পাননি। তাদের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি সবার একই অবস্থা।
বর্ষায় বৃষ্টির সঙ্গে যুদ্ধ ও গ্রীষ্মে খরতাপে পুড়তে হয় তাদের। শীতের তীব্রতা তাদের অন্যদের চেয়ে বেশি, কারণ নদী থেকে ভেসে আসা বাতাস যেন বরফের মতো ঠাণ্ডা। এ বাতাসে পুরো শরীরে কাঁপন সৃষ্টি হয়। গেল শীতে তারা কিছু কম্বল পেলেও এবার কেউই তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়নি।
নৌকায় লিজা আক্তার নামে ১১ বছরের এক শিশুর সঙ্গে বসে থাকতে দেখা যায় তার নানি বকুল বেগমকে। এসময় লিজার গায়ে কোনো শীতের পোশাক দেখা যায়নি। জানতে চাইলে লজ্জায় কথা বলতে চাচ্ছিল না লিজা। তবে তার নানি বকুল বেগম জানান, মেয়েটির বাবা চলে গেছে। এখন মায়ের আয় দিয়েই সংসার চলে। এর মধ্যে এখন তীব্র শীতের কারণে নদীতে মাছও ধরা যাচ্ছে না, তাই খুব কষ্টে তাদের দিন কাটছে।
লিজার একটি মাত্র শীতের পোশাক রয়েছে। ধুয়ে দেওয়ায় তা গায়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পোশাকটি শুকানো পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হবে। নৌকাতে শীত নিবারণের যা আছে তা গায়ে জড়িয়েই রাতে ঘুমাতে হয়। স্বামী না থাকায় বকুল তার মেঝো মেয়ে নাজমার সঙ্গে একই নৌকাতে বসবাস করেন।
সুখিয়া বেগম জানান, নদীই তাদের জীবন-জীবিকা। নদীতে জাল ফেলতে পারলেই তাদের আয় হয়। কিন্তু শীতের কারণে নদীতে যেতে পারছেন না। এতে আয় রোজগারও বন্ধ তাদের।
মানতা সম্প্রদায়ের সর্দার সৌরভ মাঝির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মজুচৌধুরীর হাট এলাকায় রহমতখালী খালে (লঞ্চঘাট এলাকা) ১২০টি ভাসমান জেলে পরিবার ছিল। এরমধ্যে ৪০টি পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর উপহার সরকারি ঘর দেওয়া হয়েছে। তারা এখন সরকারি ঘরে বসবাস করছে। তবে তারাও মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে। এখন ৮০টি পরিবার ভাসমান অবস্থায় জীবন পার করছে। এর মধ্যে মাত্র কয়েকজন আশপাশের এলাকায় জমি কিনেছে। তারা কেউই এখনও জমির সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করতে পারেনি। জমির টাকা পরিশোধের পর ঘর নির্মাণের টাকা জোগাড় পর্যন্ত ভাসমান অবস্থাতেই থাকতে হবে তাদের।
লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক আনোয়ার হোছাইন আকন্দ বলেন, ‘খুব শিগগিরই সহায়তা নিয়ে মানতা সম্প্রদায়ের কাছে যাব। তাদের মাঝে চাল ও শীত বস্ত্র বিতরণ করা হবে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সবসময়ই তাদের খোঁজ নেওয়া হয়। তাদেরকে প্রধানমন্ত্রীর উপহার ঘরও দেওয়া হয়েছে।’
এদিকে জেলা শহরেও শীতের তীব্রতা বেড়েছে। ১০ দিন আগেও রাত ১১টা পর্যন্ত জেলার বাজারগুলোতে মানুষের চলাচল ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু এখন রাত ৮টা বাজতেই বাজার শূন্য হয়ে পড়ে। তীব্র শীতের কারণে সন্ধ্যার পরই অধিকাংশ মানুষ বাড়ি চলে যায়।
চলতি শীতে লক্ষ্মীপুরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমেছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।