নিজস্ব প্রতিবেদক: লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীবেষ্টিত একটি দ্বীপ চর আবদুল্লাহ ইউনিয়ন। এটি রামগতি উপজেলার মূল ভূখণ্ড থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন। প্রায় ২৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এই ইউনিয়নের বাসিন্দাদের মূল ভূখণ্ডে যেতে হয়। প্রধানত ভৌগোলিক কারণে স্বাধীনতার এত বছর পরও এই ইউনিয়নে এখনও আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। একেবারে শূন্যের কোঠায় চিকিৎসাসেবা।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সঙ্গে এই দ্বীপ ইউনিয়নের সহজ কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় বছরের পর বছর স্বাস্থ্য ও অন্যান্য নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এখানকার বাসিন্দারা। এই পরিস্থিতিতে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, একসময় এই ইউনিয়নে কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলেও জনবল ছিল না। পরে ক্লিনিকটি যখন নদীভাঙনে বিলীন হয়ে যায়, তখন নিয়োগ দেওয়া হয় একজন স্বাস্থ্যকর্মীকে।
চর আবদুল্লাহর বাসিন্দা আমেনা খাতুন বলেন, যুগ যুগ ধরে এখানকার মায়েরা স্থানীয় কিছু অপ্রশিক্ষিত নারীর সহযোগিতায় সন্তান প্রসব করে আসছেন। ব্যথা উঠলে নদী পার হয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাওয়ার সময় হয় না। এ চরে বাল্যবিয়েরও প্রবণতা বেশি। তাই এখানকার নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে। এ চরে প্রায় ১০ হাজার মানুষের বসবাস। যাদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের জন্য অন্যতম ভরসা স্থানীয় চেয়ারম্যান বাজারের ওষুধের দোকানিরা। একই অবস্থায় রয়েছে রামগতির চর গজারিয়া ও তেলিরচরে বসবাসকারী নারী ও শিশুসহ প্রায় আট হাজার মানুষ। এ চরে কোনো এনজিওর লোকজনও যায় না।
স্থানীয়রা জানান, চর আবদুল্লাহতে এখনও আদি যুগের চিকিৎসাসেবা চলমান রয়েছে। ঝাড়ফুঁক, পানি পড়া, হাত-পা ভাঙলে বাঁশের চটি লাগানো- এসব প্রচলিত হাতুড়ে সেবা নিতে বাধ্য হচ্ছেন মানুষ। অনেকেই দীর্ঘদিনের অসুস্থতাকে সঙ্গী করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা নোয়াখালী ও ঢাকায় গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। তবে এ চিকিৎসা নিতে গিয়ে জমানো টাকা-পয়সা শেষ করে তাদের নিঃস্ব হতে হচ্ছে। নদীর লবণাক্ত পানি সেবনে বিভিন্ন ধরনের রোগের সম্মুখীন হচ্ছেন তারা।
গত বছর ৬ অক্টোবর চর আবদুল্লাহ, চর গজারিয়া ও তেলিরচরের প্রায় ২০ হাজার মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যে দুটি ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্সের উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক (ডিসি) আনোয়ার হোছাইন আকন্দ।
তখন ডিসি জানিয়েছিলেন, চর আবদুল্লাহ বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হওয়ায় যাতায়াতের সুবিধা নেই। তাই চরাঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যে ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্স চালু করা হয়েছে। কিন্তু ছয় মাস হতে চললেও একজন রোগীও এই সেবা পাননি বলে জানিয়েছেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. কামনাশিষ মজুমদার।
জানা গেছে, চর আবদুল্লাহ ইউনিয়নের ভোটার সংখ্যা ৯ হাজার ৩৩৪ জন। এখানে জলদস্যু আতঙ্ক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ আতঙ্ক সবচেয়ে বেশি। এতে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই এলাকার বাইরে রয়েছেন। আবার অনেকেই এলাকা ছাড়ার পরিকল্পনা করছেন।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন মঞ্জুর নিজেই জলদস্যু আতঙ্কে এলাকাতে থাকেন না বলে জানা গেছে। তিনি উপজেলা শহরে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন।
স্থানীয় চেয়ারম্যান বাজারের ওষুধ বিক্রেতা ইসমাইল হাফেজ জানিয়েছেন, অসুস্থ হলে মানুষজন তাদের কাছেই ছুটে আসেন। নদীপথ হওয়ায় উপজেলা শহরে যাওয়ার সুযোগ হয় না। তারা রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। যুগ যুগ ধরে এভাবেই চলে আসছে। বড় কোনো রোগ হলে তারা রোগীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু যাতায়াত সমস্যার কারণেই বাধ্য না হলে কেউ যেতে চান না।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ও চর আবদুল্লাহর কয়েক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন বছর আগে এ ইউনিয়নে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক ছিল। পরে নদীর ভাঙনে তা বিলীন হয়ে গেছে। তখন কোনো জনবল ছিল না। খালি পড়ে ছিল ক্লিনিকটি। সম্প্রতি একজন লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন ক্লিনিকের চিহ্নও নেই।
চরের কিছু অংশ নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার অধীনে রয়েছে। একসময় এ চরের মানুষগুলোও স্বাভাবিক জীবনযাপন করার স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু এখনও তা কল্পনাও করা যায় না।
উপজেলা স্বাস্থ্য সহকারী ফরহাদ হোসেন বলেন, শিশুদের নিয়মিত টিকা দেওয়ার জন্য তিনি প্রতি মাসে দুবার চর আব্দুল্লাহতে যান। সহকর্মী মাহমুদুল হাসানও তার সঙ্গে যান। সেখানে গিয়ে একদিন থেকে পরদিন আসেন। সম্প্রতি তার সহকর্মী দুর্ঘটনা হাত ভেঙে গেলে অন্য লোক নিয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি চরে গিয়ে প্রায় ১৪০০ শিশুকে ভিটামিন এ প্লাস ক্যাপসুল খাইয়েছেন। এবার এ চরে ১৫০০ শিশুকে এ প্লাস ক্যাপসুল খাওয়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
চর আবদুল্লাহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন মঞ্জুর বলেন, চারপাশেই পানি। এ চরের মানুষ অতি দরিদ্র। সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুটি ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্স চালু করা হয় চরাঞ্চলের মানুষের সেবা নিশ্চিতের জন্য। কিন্তু চর থেকে অ্যাম্বুলেন্সে নদী পাড়ি দিতেই প্রায় চার হাজার টাকা খরচ হবে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. কামনাশিষ মজুমদার জানান, রামগতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৩১ শয্যাবিশিষ্ট। কিন্তু অবকাঠামো মাত্র ২০ শয্যার। ইউনিয়নে কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য কোনো জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। নিয়োগ দেওয়া হবে বলে শুনেছেন। তবে সেখানে কমিউনিটি ক্লিনিকও নেই। বছর কয়েক আগে ভেঙে তা বিলীন হয়ে গেছে। ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্সগুলো এখনও কোনো কাজে আসেনি।
তবে রামগতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এসএম শান্তনু চৌধুরীর দাপ্তরিক মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
জেলা সিভিল সার্জন (সিএস) আহাম্মদ কবির বলেন, নতুন করে চর আবদুল্লাহ কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের জন্য কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। বরাদ্দ পাবেন বলে আশা করছেন।