আজ থেকে ঠিক এক মাস আগে লক্ষ্মীপুরে বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচিতে যোগ দিতে এসে দুর্বৃত্তদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মাত্র ১৯ বছর বয়সে প্রাণ হারান কৃষক দল কর্মী সজিব। আজও এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাহলে এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কারা ছিল- এ প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে। তবে পুলিশ বলছে, সবজি হত্যার রহস্য উদঘাটন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণে রয়েছে। জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে।
এদিকে সজিবকে হারিয়ে তার মা নাজমা বেগম ও বাবা আবু তাহের বারবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার জন্য বেশিরভাগ সময় ঢাকা-বাড়িতে আসা-যাওয়া করছেন।
সরেজমিনে সজিবদের বসতঘরে গিয়ে দেখা যায় তালা ঝুলছে। ফলে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। নিকটতম আত্মীয়দের কাছ থেকে, তাদের ব্যবহৃত মোবাইল নাম্বারটিও নেওয়া সম্ভব হয়নি। তারাও সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য দিচ্ছেন না। সজিবের বাবা-মা কোথায় আছেন- এমন প্রশ্ন করলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তারা বলেন, আমাদের সজিব খুন হয়েছে। আমরা বিচার পাচ্ছি না। উল্টো হয়রানির শিকার হচ্ছি। এখান থেকে আপনারা চলে যান। পরবর্তী সময় কেউ এলে এই বাড়িতে আমরা অপমান করব।
আশপাশের প্রতিবেশীরা বলছেন, পুলিশ আসা-যাওয়াতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছেন স্থানীয়রা। বারবার পুলিশের বিভিন্ন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় স্বজন ও স্থানীয়দের। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মামলার তদন্তের কাজে সজিবদের বাড়িতে যাওয়া হয়। পুলিশ অযথা কাউকে হয়রানি করছে না এবং করবে না।
নিহত সজিব সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের (৮ নম্বর ওয়ার্ড) ধন্যপুর গ্রামের কফিল মেম্বার বাড়ির আবু তাহের ও নাজমা বেগমের ছোট ছেলে। পেশায় টাইলস মিস্ত্রি ছিলেন। তিনি স্থানীয় বিএনপির একজন সক্রিয় কর্মী বলে দাবি করছে দলটি।
গত ১৮ জুলাই লক্ষ্মীপুরে বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচিতে স্থানীয় বিএনপির অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগ দেন সবজি। ওইদিন শহরে কলেজ রোড় সংলগ্ন মমিন উল্লাহ হাউজিংয়ের সামনে দুর্বৃত্তরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে সজিবকে কুপিয়ে জখম করে। রক্তমাখা শরীর নিয়ে সালমা চৌধুরী নামে এক বাসায় গিয়ে আশ্রয় নেন সজিব। ওই বাসার কেউ একজন জাতীয় সেবা-৯৯৯ কল দিয়ে পুলিশকে বিষয়টি জানান। পরে পুলিশ গিয়ে মুমূর্ষু অবস্থা সজিবকে উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে নিয়ে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পরদিন তখনকার সময় পুলিশ সুপার (এসপি) মাহফুজ্জামান আশরাফ সংবাদ সম্মেলন করে জানান, সজিব নামে যে যুবক খুন হয়েছে তাকে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে দুর্বৃত্তরা ধারালো অস্ত্র অথবা ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। কোনো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নয়। বিএনপির দাবিকৃত সজিব নামক এক যুবক হত্যাকাণ্ডের যে ঘটনা ঘটেছে, তা প্রাথমিক অনুসন্ধানে কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। বিএনপির সঙ্গে পুলিশের যে স্থানে সংঘর্ষ হয়, সেখান থেকে হত্যাকাণ্ডের স্থানের দূরত্ব আনুমানিক দুই থেকে আড়াই কিলোমিটার।
একইদিন দুপুর ১টার দিকে কেন্দ্রীয় বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি তার লক্ষ্মীপুরের বাসভবন প্রাঙ্গণে নিহত সজিবের আত্মার মাগফেরাত কামনায় গায়েবানা জানাজায় অংশগ্রহণ করে বলেন, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সজিবকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। এর নেতৃত্বে ছিল সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মহসিন কবির সাগর ও সাধারণ সম্পাদক সেবাব নেওয়াজ। এটি সম্পন্ন একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। আর পুলিশ এখন বলছে সজিব হত্যাকাণ্ড অরাজনৈতিক। এতে বোঝা যাচ্ছে পুলিশ এ হত্যাকাণ্ডে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে সহযোগিতা করেছে। এ খুনের সঙ্গে জড়িত সবাইকে আমরা শনাক্ত করছি। এ ঘটনায় মামলা হবে। আমরা এর উপযুক্ত বিচার চাই। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সকলকে দ্রুত গ্রেফতার করতে হবে।
এদিন বিকেলে লক্ষ্মীপুর সদর মডেল থানায় হত্যার ঘটনায় নিহত সজিবের ভাই মো. সুজন হোসেন বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা একাধিক আসামির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
দুই দিন পর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নূরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন (এমপি) সংবাদ সম্মেলন করে সজিব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন।
কেন্দ্রীয় বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি মোবাইলে বলেন, ইতোপূর্বে কেন্দ্রীয় বিএনপির পক্ষ থেকে নিহত কৃষক দল কর্মী সজিবের মা-বাবার হাতে পাঁচ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়। ঢাকা যাওয়ায় সজিবের মা-বাবাকে সহযোগিতা করছেন স্থানীয় ইউপি সদস্য কফিল উদ্দিন (মেম্বার)।
তিনি কী জন্য সহযোগিতা করছেন এজন্য পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে মামলা দিয়েছে। বর্তমানে কফিল মেম্বার কারাগারে বন্দী। পুলিশ অন্যায়ভাবে এই কাজটি করছে। পুলিশের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সজিবের বাবা-মা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আত্মগোপনে আছেন। একদিকে তারা সন্তানহারা যন্ত্রণা ভুগছেন, অন্যদিকে পুলিশের বারবার উপস্থিতির কারণে তারা মানসিক চাপে আছেন। এক মাস পার হয়ে যাচ্ছে এখন পর্যন্ত পুলিশ সজিব হত্যার রহস্য উদঘাটন অথবা একজন আসামিকে আইনের আওতায় আনতে পারেনি।
জানতে চাইলে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যন্ড অপস্) বলেন, সজিব হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিষয় আমরা নিবিড়ভাবে তদন্ত করছি। বিভিন্নভাবে বিভিন্ন তথ্য পাওয়ার কারণে পুলিশ অনেক সময় বিভ্রান্ত হতে হয়। তাই আমরা চাই একজন নিরপরাধ মানুষ যেন হয়রানি না হয়। সেই বিষয় লক্ষ্য রেখে তদন্ত করছি। আশা করি অচিরেই এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে।
স্থানীয় কফিল উদ্দিন মেম্বারের বিষয় জানতে চাইলে পুলিশের এ কর্মকর্তা জানান, তদন্ত ছাড়া কিছুই বলা যাচ্ছে না।
সূত্র: ঢাকা মেইল।