ডাচবাংলা ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের চর লরেঞ্চ বাজার এবং করইতোলা বাজার এজেন্ট আউটলেটের উদ্যোক্তা মো. মহিউদ্দিন মাহমুদ(৪৬) গত ২৫ সেপ্টেম্বর তারিখ থেকে নিখোঁজ রয়েছে। তার খোঁজ নেই কোথাও। এঘটনায় আউটলেট দুটির সাময়িক ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধের নোটিশ টানিয়ে দিয়েছে ডাচ ব্যাংক কর্তপক্ষ। শুক্রবার পর্যন্ত শাখা দুটির উদ্যোক্তার কোন খবর জানাতে পারেনি তার স্বজনরা। স্থানীয় থানায় কোন জিডি হয়নি।
মহিউদ্দিন মাহমুদ হাজিরহাট ইউনিয়নের চর জাঙ্গালিয়া গ্রামের ডা. হাবিব উল্লার ছেলে। তিনি এলাকায় কুতুব উল্লাহ নামে পরিচিত ছিলেন। তার মালিকানাধীন লাবিব এন্টারপ্রাইজ ও তাজ এন্টারপ্রাইজ নামের দুটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অধীন ডাচবাংলা ব্যাংকের দুটি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট পরিচালিত হচ্ছে। যার মধ্যে চর লরেঞ্চ বাজার এজেন্ট আউটলেটটি মাস্টার এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে।
বৃহস্পতি ও শুক্রবার (২৯ সেপ্টেম্বর) চর লরেঞ্চ বাজারে গেলে স্থানীয় কয়েকজন অভিযোগ করে জানান, এজেন্ট ব্যাংকিং এর আড়ালে সুদের ব্যবসায় ব্যক্তিগত ব্ল্যাঙ্ক চেকের গ্যারান্টি ও উচ্চ সুদের লোভ দেখিয়ে স্থানীয় লোকজনের কয়েক কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা মো. মহিউদ্দিন মাহমুদ। এতে নিজেদের পূজিঁ হারিয়ে সর্বশান্ত হয়ে গেছে বহু মানুষ।
এসময় সুমন নামের একজনসহ কয়েকজন গ্রাহক জানায়, এজেন্ট শাখাটিতে তার একাউন্টে সরাসরি গচ্ছিত টাকা ঠিক আছে। তবে উদ্যোক্তা মাহমুদের সাথে যারা ব্যক্তিগত ভাবে ব্ল্যাঙ্ক চেকের গ্যারান্টি ও স্ট্যাম্প গ্যারান্টিতে মাসিক উচ্চ লাভের আশায় টাকা জমা রেখেছিলেন মাহমুদ না ফিরলে তারা সর্বশান্ত হবেন।
মুক্তিযোদ্ধা হাজী নুরুল ইসলাম জানান, মহি উদ্দিন উধাও হওয়ার খবর ছড়ি পড়লে ২৬সেপ্টেম্বর থেকে এজেন্ট শাখাটিতে এসে বহুলোক ভীড় জমায়। পরে আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশংকায় ডাচ ব্যাংকের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গিয়ে একটি নোটিশ টানিয়ে দিয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে। জড়ো হওয়া লোকজনের অনেকে জানিয়েছে ব্যাংকের একাউন্টের বাহিরে ব্যক্তিগতভাবে এজেন্ট মহিউদ্দিন মাহমুদের নিকট বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা রেখে মাসিক লাভ নিচ্ছিল। এখন সে উধাও হওয়ার খবরে নিজেদের গচ্ছিত টাকা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা। তবে এরকম কতজন ব্যক্তি রয়েছে তার কোন সঠিক হিসেবে জানাতে পারেনি কেউ।
স্থানীয় ভাবে বিভিন্নজন কোটি কোটি টাকার হিসেবে দিচ্ছে। তবে এপ্রতিবেদকের নিকট ৭ কোটি ৪০ লাখ টাকার একটি হিসেব এসেছে। এজেন্টের প্রতারণায় পড়ে নিজেদের ক্ষতির আশংকা করে ডাচবাংলা ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে নিকট নিজেদের অর্থের পরিমাণ এবং গ্যারান্টি হিসেবে ব্যাংক চেক ও স্ট্যাম্পের কথা জানিয়ে চিঠি লিখেছে বহু ব্যক্তি।
চর লরেঞ্চ গ্রামের চুঙ্গার গোড়ার বাসিন্দা মোঃ মোসলেহ উদ্দিন জানায়, দীর্ঘদিন থেকে সুনামের সাথে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল এজেন্ট শাখাটি। ভালো আচরণের মাধ্যমে গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করেন। আমি প্রবাস থেকে দেশে আসার পর ৬ লাখ টাকার একটি ডিপিএস করি ওই শাখায়। এক পর্যায়ে মহিউদ্দিন মাহমুদ আমার ডিপিএসে জমানো অর্থগুলো উত্তোলন করে তার নিকট বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয়। এতে তিনি প্রতিমাসে লাখে ১২শ টাকার ঘোষণা দেয়। পরে আমি একদিন ফিঙ্গার দিয়ে একাউন্টের ৬ লাখ টাকা তুলে তার হাতে দিই। পরে তিনি আমাকে গ্যারান্টি হিসেবে একটি চেক ও স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর দিয়ে দেন। কয়েক মাস নিয়মিত লাভও আমাকে দিয়েছেন। এখন শুনি সে উধাও।
চর লরেঞ্চ গ্রামের ইউছুপ অন্য একটি ব্যাংকের ঋণ নিয়ে ৭ লাখ এবং অন্যান্য আত্মীয়ের ২৩লাখ সহ মোট ৩০ লাখ মহিউদ্দিন মাহমুদের নিকট মাসিক লাখে ১২শ টাকা লাভে জমা রেখেছিল। গত কয়েক মাস লাভও পেয়েছেন। চর জাঙ্গালিয়ার হারুনের ৫ লাখ, জুয়েলের ১৭ লাখ, চর জগবন্ধুর তানিয়া আক্তারের ৪ লাখ সহ অসংখ্য স্থানীয় এলাকাবাসীর লাখ লাখ টাকা মহিউদ্দিন মাহমুদের নিকট মাসিক লাভে জমা রাখার খবর জানা গেছে। মহিউদ্দিন মাহমুদের উধাও হওয়ার খবরে তারা সবাই ভেঙ্গে পড়েছে।
ডাচবাংলা ব্যাংকের এজেন্ট আউটলেটের টেইলর জান্নাতুল ফেরদৌসী অপি জানায়, ঘটনার দিন বেলা ১টার দিকে আমার ৪ সহকর্মী দুপুরে খেতে বের হয়। আমি তখন একা ছিলাম ব্যাংকে। এসময় আমাদের মালিক কুতুব উল্লাহ বাহির থেকে এসে তার ব্যবহৃত ২টি মোবাইল ফোন ও ব্যাংক কার্ড রেখে বলেছিল তাকে কেউ একজন বাহিরে ডাকছে। আমি ফোন ও কার্ড রেখে গেলাম। এর প্রায় ৪০ মিনিট পর তিনি অন্য একটি নাম্বার থেকে তার একটি ফোনে কল দেয়। ফোনটি আমি রিসিভ করি। তখন তিনি আমাকে জানায়, অপি ২ জন লোক আমাকে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে, তারা আমার সাথে খারাপ আচরণ করছে। তুমি এ বিষয়টি আমার ভাইকে জানাও। এ কথা শুনেই আমি সাথে সাথে তার ভাই হারুন অর রশিদকে ঘটনাটি জানাই।
এদিকে মহিউদ্দিন মাহমুদের ভাই হারুন অর রশিদ জানায়, আমি অপির কল পাওয়ার সাথে সাথেই ৯৯৯ এ কল দিয়ে পুলিশের সহযোগীতা চাই। এবং করইতোলা থেকে চর লরেঞ্চ চলে যাই। ততক্ষণে থানা থেকে পুলিশ আসে। এর পর থেকে আজ পর্যন্ত আমার ভাইয়ের আর কোন খোঁজ নেই।
মহিউদ্দিন মাহমুদ পরিবার নিয়ে লক্ষ্মীপুর জেলা শহরে বসবাস করতো। তার ২ মেয়ে রয়েছে। স্ত্রী শিল্পী আক্তারের নাম্বারে কল দিয়ে বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে মহিউদ্দিনের ভাই হারুন অর রশিদ জানায়, এ ঘটনার পর আমার ভাবী অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়া হয়েছে। আমি প্রকৃত ঘটনাটি জানার চেষ্টা করছি।
কমলনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সোলাইমান বলেন, ঘটনার দিন ৯৯৯ এর কল পেয়ে আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। তবে এখন পর্যন্ত থানায় কোন প্রকার জিডি কিংবা কোন অভিযোগ আসেনি। তবুও পুলিশ ঘটনাটি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিবে।
এবিষয়ে জানতে চাইলে ডাচ্-বাংলা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের কম্পলাইন ম্যানেজার মোঃ মাইন উদ্দিন মিয়া জানান, এ ঘটনার পর থেকে এজেন্ট আউটলেট দুটি সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে গ্রাহকরা যে কোন শাখা থেকে তাদের লেনদেন করতে পারবে।
অন্যদিকে মহিউদ্দিন মাহমুদ ব্যক্তিগত ব্যাংক চেক ও স্ট্যাম্প দিয়ে মানুষ থেকে যেসমস্ত টাকা নিয়েছেন সে দায়ভার ব্যাংক নিবে না। ব্যাংকের একাউন্টে রাখা সব টাকা নিরাপদে রয়েছে। মহি উদ্দিন মাহমুদ কত মানুষ থেকে ব্যক্তিগত ভাবে টাকা নিয়েছে তা আমরা খোঁজ নিচ্ছি। আমাদের নিকট ৬০-৭০ জানিয়েছে। এদের মধ্যে কেউই আমাদের ব্যাংকে টাকা রাখার কোন প্রমাণ দেখাতে পারেন নি। গ্রাহকদের অভিযোগ পাওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে এবং কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।