লক্ষ্মীপুর চার আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই নৌকার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী

প্রতিনিধি :লক্ষ্মীপুর চার আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই নৌকার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। নির্বাচনঅ মাঠে লড়াই হচ্ছে সমানে সমান। এলড়াই এখন প্রকাশ্য বিরোধে রূপ নিয়েছে। লক্ষ্মীপুরের চারটি আসনের চিত্র একই রকম।আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুরের চারটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দিতা করছেন ৩০ প্রার্থী। জেলার চারটি আসনে নৌকার প্রার্থীরা হচ্ছেন, লক্ষ্মীপুর-১ রামগঞ্জে বর্তমান সংসদ সদস্য ড. আনোয়ার হোসেন খান, লক্ষ্মীপুর-২ রায়পুর ও সদর আংশিক বর্তমান সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন, লক্ষ্মীপুর-৩ সদর আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান এমপি গোলাম ফারুক পিংকু ও লক্ষ্মীপুর-৪ রামগতিতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ (ইনু) থেকে মোশাররফ হোসেন কে জোটগত ভাবে মনোনয়ন দেয়া হয়। কিন্তু নৌকার দাপুটে প্রার্থীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কারণে।
লক্ষ্মীপুর-১ (রামগঞ্জ) আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বর্তমান এমপি আনোয়ার হোসেন খানের সঙ্গে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও জেলা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান, কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হাবিবুর রহমান পবন ও সাবেক সংসদ সদস্য এমএ গোফরান, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের নিয়াজ মাখমুদ ফারুকী, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির মোশারফ হোসেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।

এ আসনে পবন ও মোশারফ আপিলের মাধ্যমে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। কিন্ত ডিসি-এসপিকে তিন দিনের মধ্যে বদলির দেওয়ার হুমকি দেওয়ায় লক্ষ্মীপুর-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান পবনের প্রার্থিতা বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গতকাল মঙ্গলবার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তবে পরে তিনি বুধবার হাইকোর্টের রিট করে তার প্রার্থীতা ফিরে পান।

লক্ষ্মীপুর-২ (রায়পুর ও সদরের একাংশ) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান এমপি নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়নের সঙ্গে তার স্ত্রী রুবিনা ইয়াছমিন লুবনাসহ ১২ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। এ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শহীদ ইসলাম পাপুলের স্ত্রী সংরক্ষীত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য কাজী সেলিনা ইসলাম, জাতীয় পার্টির প্রার্থী বোরহান উদ্দিন আহমেদ মিঠু, তৃণমূল বিএনপির আবদুল্লাহ আল মাসুদ, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টর জহির হোসেন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) আমির হোসেন, মুক্তিজোটের ইমাম উদ্দিন সুমন, বাংলাদেশ কংগ্রেসের মনসুর রহমান দাদন গাজী, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের মোরশেদ আলম ও বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের শরীফুল ইসলাম, স্বতন্ত্র প্রার্থী এ এফ এম জসিম উদ্দিন আহমেদ ও ফরহাদ মিয়া প্রার্থী।

লক্ষ্মীপুর-৩ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান এমপি গোলাম ফারুক পিংকুর সঙ্গে স্বতন্ত্র হিসেবে মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমএ সাত্তার, জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও জেলা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাকিব হোসেন, জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ আবদুর রহিম, তৃণমূল বিএনপির নাঈম হাসান ও বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির মাহবুবুল করিম টিপু প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি-কমলনগর) আসনে নৌকার প্রার্থী হিসেবে প্রথমে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলিকে মনোনীত করে দল। কিন্তু বরাবরই আসনটি মহাজোটের শরিকদের দেয় আওয়ামী লীগ। বর্তমান এমপি বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) আব্দুল মান্নানও আওয়ামী লীগের শরিক দলের হয়ে নৌকা নিয়ে ভোট করে ২০১৮ সালে নির্বাচিত হন।

এবার প্রথমে দলীয় প্রার্থী দিলেও বৃহস্পতিবার (১৪ ডিসেম্বর) রাতে শরিক দলের একান্ত বৈঠকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ ইনু) সহসভাপতি মোশারফ হোসেনের নাম ঘোষণা করা হয়। নৌকার প্রার্থী মোশারফের সঙ্গে এ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মো. আবদুল্লাহ ও তার স্ত্রী মাহমুদা বেগমসহ চারজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। অন্যরা হলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির মোহাম্মদ ছোলায়মান, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ইস্কান্দার মির্জা শামীম।

এদিকে, গত ২৬ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী সেলিনা ইসলাম বলেছেন, নৌকার কর্মীরা আমার লোকজনের ওপর হামলা চালাচ্ছে। আমার এজেন্ট হলে ৭ জানুয়ারির পর দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। আমার এজেন্ট হলে তাদের ঘর জ্বালিয়ে দেওয়ারও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এর আগে তিনি দুপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে রায়পুর পৌরসভা লেংড়া বাজার এলাকায় নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করেন। সেখানে দূর্বৃত্তরা তার লোকজনের ওপর হামলা করেছে বলে জানিয়েছেন তিনি। এ সময় এক কর্মীকে মারধর করে আহত করা হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।

এ ছাড়া গত ৩১ ডিসেম্বর দুপুর দেড়টার দিকে রায়পুর উপজেলার কেরোয়া ইউনিয়নের কাপিলাতলি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে স্বতন্ত্র প্রার্থী সেলিনা ইসলামের (ঈগল) প্রধান নির্বাচনী সমন্বয়ক শেখ ফায়িজ উল্যাহ শিপনকে এক যুবক প্রকাশ্যে চড় মেরে পালিয়েছেন। রোববার (৩১ ডিসেম্বর) বিকেলে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ ৯টি দপ্তরে এ অভিযোগ করেন শিপন। শিপনকে থাপ্পড় দেওয়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে দেখা যায়, এক যুবক জনসম্মুখে শিপনকে চড় দিয়ে পেছনে হেঁটে চলে যাচ্ছেন। এসময় শিপনের নেতাকর্মীরা তাকে ধাওয়া করেন। ঘটনাস্থলে স্বতন্ত্র প্রার্থী সেলিনা ইসলামও উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে, লক্ষ্মীপুর-৩ (সদর) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী এমএ সাত্তারের (ট্রাক প্রতীক) পক্ষে কাজ করায় আওয়ামী লীগের ১১ নেতাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার (২৬ ডিসেম্বর) রাত ১০টার দিকে চন্দ্রগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল কাশেম চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওহাব স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। ভবিষ্যতে তারা দলীয় কোনো পদের জন্য প্রার্থী হতে পারবেন না বলেও সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়।

অব্যাহতিপ্রাপ্ত নেতারা হলেন- চন্দ্রগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অহিদুজ্জামান বেগ বাবলু, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন পাটওয়ারী, কোষাধ্যক্ষ হারুনুর রশিদ পাটওয়ারী, শ্রম সম্পাদক নাছির পাটওয়ারী, সাংস্কৃতিক সম্পাদক হুমায়ুন কবীর, সদস্য সামছুল আলম বাবুল পাটওয়ারী, নুরুল আমিন, সোহরাব হোসেন রুবেল পাটওয়ারী, লোকমান মাস্টার ও মো. খালেদ। একই অভিযোগে এর আগে ১৯ ডিসেম্বর মান্দারী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মাসুদকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

চন্দ্রগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওহাব বলেন, দলের কার্যক্রমে অনুপস্থিত, গঠনতন্ত্র পরিপন্থি ও অনৈতিক কার্যকলাপে যুক্ত থাকায় জেলা আওয়ামী লীগের নির্দেশনায় ১১ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অব্যাহতিপ্রাপ্ত নেতারা কোন প্রার্থীর ভোট করে তা আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়।
অন্যদিকে, লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি ও কমলনগর) আসনে নৌকা প্রার্থীর পক্ষে কাজ না করে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আবদুল্লাহকে সমর্থন জানিয়েছেন লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল ওয়াহেদ মুরাদ। তার দাবি, কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ীই তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন।

আবদুল ওয়াহেদ মুরাদ সাংবাদিকদেও বলেন, লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি ও কমলনগর) আসনে সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ যোগ্য প্রার্থী। তাকে প্রার্থী হওয়ার জন্য আমরা অনুরোধ জানিয়েছি। তিনি আমাদের অনুরোধ রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশেই আবদুল্লাহ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নির্বাচন আনন্দঘন করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনেই আমি আবদুল্লাহকে সমর্থন জানিয়েছি।

নৌকা প্রার্থীর বিপক্ষে যাওয়ার কারণ হিসেবে আবদুল ওয়াহেদ মুরাদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের যে কাউকে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচনের লক্ষ্যে এ সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। যোগ্য প্রার্থী হিসেবে মনে করে আমি আব্দুল্লাহকে সমর্থন জানিয়েছি।
এছাড়া, ডিসি-এসপিকে তিন দিনের মধ্যে বদলির দেওয়ার হুমকি দেওয়ায় লক্ষ্মীপুর-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান পবনের প্রার্থিতা বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। মঙ্গলবার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। পরে তিনি উচ্চ আদালতে রিট করে প্রার্থীতা ফিরে পান।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই প্রথম আচরণ বিধি লংঘনের দায়ে কোনো প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করল কমিশন। এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠি রিটার্নিং কর্মকর্তাকে দিয়েছেন ইসি।
প্রতিবেদনে এ প্রার্থীর বিরুদ্ধে একাধিকবার এ ধরনের আচরণ করার অভিযোগ আনেন। এ ঘটনায় কেন তার প্রার্থিতা বাতিল করা হবে না- তা জানতে চেয়ে মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান পবনকে গত সোমবার নির্বাচন কমিশনে তলব করা হয়। বিকাল ৩টায় শুনানি শুরুর কথা থাকলে এ প্রার্থী শুনানিকক্ষে নির্ধারিত সময়ের ২২ মিনিট পরে প্রবেশ করেন। শুনানিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল ও তিনজন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান, নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশেদা সুলতানা ও মো. আনিছুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে, পবনের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক ও জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা সুরাইয়া জাহান নির্বাচন কমিশন বরাবর লিখিত চিঠি দেন। শনিবার (৩০ ডিসেম্বর) ইসি বরাবর স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সুপারিশ করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।

লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা সুরাইয়া জাহান বলেন, আসন্ন দ্বাদশ নির্বাচন আলিফের মতো সোজা হবে। কোনো দিকে তাকানো যাবে না। আমাদের দৃষ্টিতে সবাই সমান। আমরা সেভাবেই কাজ করছি। এটুকু নিশ্চয়তা আপনাদের দিতে পারবো। এ বার্তা আমাদের নির্বাচন কমিশন থেকে স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে। আমরাও ঠিক সেইভাবে কাজ করছি শুরু থেকে এখন পর্যন্ত। আশাকরি নির্বাচনের শেষদিন পর্যন্ত আলিফের মতো থাকবো

আরও পড়ুন