ডেঙ্গুতে এ পর্যন্ত ১১৯ শিশু-কিশোরের মৃত্যু

সারাদেশেই ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। নবজাতক থেকে শুরু করে বৃদ্ধ কেউই রেহাই পাচ্ছে না ডেঙ্গুর হাত থেকে। এ বছর ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছে ৬৩৪ জন। তন্মধ্যে ১১৯ জনই শিশু-কিশোর। যা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট মৃত্যুর ২৬ শতাংশ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি কন্ট্রোল রুম এবং ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম শাখার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি বছর ডেঙ্গুতে শূন্য থেকে ২০ বছর বয়সি ১১৯ শিশু-কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে মেয়ে শিশু ও কিশোরের মৃত্যু ছেলেদের তুলনায় বেশি, ৬২ জন। আর ছেলে শিশু-কিশোরের মৃত্যুর সংখ্যা ৫৭। সবচেয়ে বেশি মারা গেছে ১৬ থেকে ২০ বছর বয়সিরা। এই বয়সসীমার ৪৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে মেয়ে ২০, ছেলে ২৪ জন। এছাড়া শূন্য থেকে ৫ বছর বয়সি শিশুর মধ্যে মেয়ে শিশু ১৪, ছেলে শিশু ৯, ৬ থেকে ১০ বছর বয়সি মেয়ে শিশু ১৮, ছেলে ১৪, ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সি মেয়ে শিশু ১০, ছেলে শিশু ১০।

সাভারে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে স্কুলছাত্রী রওনক মৃধা। মাত্র ১১ বছর বয়স তার। সৃষ্টি সেন্ট্রাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ছিল সে। হেসে-খেলে কাটানোর এই বয়সে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে হার মানতে হয়েছে তাকে। তার মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছে পুরো পরিবার।

রাজধানীর মধ্য পাইকপাড়ার ছাপাখানা মোড়ের বাসাটিতে এখন শুধুই পিনপতন নিরবতা। এই বাড়ির বাসিন্দা মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও রাবেয়া আক্তার দম্পতির ঘর আলো করে রাখা দুই সন্তান আরাফাত হোসেন ও রাইদা মারা গেছে এক সপ্তাহের মধ্যে। এই অকালমৃত্যুর কারণ ডেঙ্গু। আদরের দুই সন্তানকে হারিয়ে শোকে পাথর বাবা-মা।

বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও সিট সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ৩ দিন ধরে জ্বরে বাসায় থেকে চিকিৎসা নিলেও অবস্থা খারাপের দিকে যাওয়ায় ১২ সেপ্টেম্বর আদ দ্বীন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৭ বছর বয়সি কিশান দীক্ষিত। তার বাবা দুলক দীক্ষিত জাগো নিউজকে জানান, ছেলের ডেঙ্গু হয়েছে। প্রথমে অবস্থা ভালো থাকায় বাসায়ই ছিল। খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে সে, দুর্বল হয়ে পড়েছে, বমি করছে। পরে হাসপাতালে এনে ভর্তি করাই।

রাজধানীর শিশু হাসপাতাল ঘুরেও দেখা যায়, ডেঙ্গু ওয়ার্ডগুলোতে ফাঁকা নেই কোনো সিট। নবজাতক থেকে ১৮ বছরের শিশুরা এখানে ভর্তি হচ্ছে ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে। তবে ডেঙ্গুর বিপজ্জনক চিহ্ন দেখেই ভর্তি নিচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে, সিট না থাকলে সোহরাওয়ার্দী কিংবা অন্যান্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।

শিশু হাসপাতালের তথ্য অনু্যায়ী, ১৩ সেপ্টেম্বর হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে ১০৫ জন শিশু। একই সময়ে ভর্তি হয়েছে ২১ জন। হাসপাতালটিতে এ পর্যন্ত ১৪ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

শিশু হাসপাতালের ডেঙ্গু বিভাগের ইনচার্জ ডা. ফারহানা আহমেদ জানান, যাদের বিপজ্জনক লক্ষণ আছে সেসব ডেঙ্গু রোগীকেই ভর্তি করা হয়। তবে এবছর অন্যান্য বারের তুলনায় ডেঙ্গু রোগী বেশি। যার কারণে দ্বিগুণ করতে হয়েছে হাসপাতালের বেড। যেসব শিশুর অন্য কোনো শারীরিক জটিলতা রয়েছে, তাদের নিয়ে ঝুঁকিটা আরও বেশি।

শিশু হাসপাতালের পরিচালক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ডেঙ্গুসহ যে কোনো অসুখে শিশুরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। শিশুদের ইমিউনিটি অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। বিশেষ করে এক বছরের কম বয়সি বাচ্চাদের ডেঙ্গু হলেই পরিস্থিতি ভয়ংকর হতে পারে। ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের পালমোনারি হেমারেজ বেশি হয়। সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করতে না পারলে মালটি-অরগান ফেইলর হয়ে শিশু মারা যেতে পারে। এছাড়া তাদের ফ্লুইড ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে নরমাল স্যালাইন দেওয়া যায় না। তিন মাসের নিচের বাচ্চাদের বেবি স্যালাইন লাগে। শিশুদের ফ্লুইড প্রয়োগের হিসাব একটু কঠিন। রোগের ধরন বুঝে সঠিক মাত্রায় ফ্লুইড দিতে না পারলে, ওভার ডোজ পড়লে পরিস্থিতি মারাত্মক হতে পারে।

ডেঙ্গু রোগের বিপজ্জনক লক্ষণ সম্পর্কে চিকিৎসকরা জানান, শিশুদের জ্বর আসলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। আর যখন বিপজ্জনক পরিস্থিতি যেমন যেমন পেটব্যথা, অনবরত বমি, শরীরে পানি জমা, নাক, মাড়ি থেকে রক্তপাত, অতিরিক্ত দুর্বলতা, অস্থিরতা, লিভার স্ফীতি দুই সেন্টমিটারের বেশি, ল্যাব পরীক্ষায় রক্তে হিমাটোক্রিটের মান বৃদ্ধি, অণুচক্রিকা দ্রুত কমতে থাকা। এ রকম কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। ডেঙ্গু জ্বরের পাঁচ থেকে সাত দিন সময়কালে ‘মারাত্মক ডেঙ্গুর’ চিহ্নাদি দেখা দিতে পারে। যেমন ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (যা ৫ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়), শরীরে পানি জমা, নাড়ি দুর্বল, শীতল শরীর (তাপমাত্রা ৯৬.৮ ডিগ্রি ফারেনহাইটের কম), রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে কমা, অতিরিক্ত রক্তপাত, লিভার এএসটি বা এএলটির মান ১০০০ বা বেশি, অচৈতন্য অবস্থা, হার্ট ও অন্যান্য অঙ্গে রোগের লক্ষণ প্রভৃতি।

 

আরও পড়ুন