পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় সম্পর্ক বাবা-মামা ও সন্তানের মধ্যে। এরমধ্যে সন্তান তার বাবা-মাকে হারালে সারাজীবন বুকে কষ্ট নিয়ে বাঁচতে হয়। আর যদি সন্তান মারা যায় কিংবা নিখোঁজ থাকে তাহলেও বাবা-মা শান্তিতে ঘুমাতেও পারেন না। ঠিক তেমনই একটি ঘটনা রয়েছে লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জের সোনাপুর এলাকায়। বৃদ্ধ স্বামী-স্ত্রী এখনো তাদের বড় ছেলের জন্য পথ চেয়ে রয়েছেন। আশপাশের সবাই বলছেন তাদের ছেলে মারা গেছেন। আর তাদের দাবি সে বেঁচে আছে।
ছেলে শোকে পাগলপ্রায় সেই বৃদ্ধ দম্পতি হলেন আবদুল বাকের (৭৬) ও রওশন বেগম (৭০)। তারা রামগঞ্জ পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের সোনাপুরের রেয়াজ উদ্দন হাজি বাড়ির বাসিন্দা। গত ৪০ বছর ধরে বড় ছেলে মো. আলমের জন্য অপক্ষো তারা করছেন। প্রকাশ্যে-গোপনে এখনো সেই ছেলের জন্য চোখের পানি ঝরাচ্ছেন। স্বপন আহম্মেদ (৩০) নামে তাদের আরও একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। একসময় সে সুস্থ্য থাকলেও এখন সেই প্রতিবন্ধী অবস্থায় বেঁচে আছে।
হারানো ছেলের শোক আর প্রতিবন্ধী ছেলের কষ্ট দুটি পাহাসম দুঃখ বৃদ্ধ দম্পতির। সরেজমিনে গিয়ে আশপাশের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাকেরের সেলিম নামে এক প্রতিবন্ধী ভাই আছে। জন্মলগ্ন থেকেই সেই প্রতিবন্ধী। ভিক্ষাবৃত্তি করেই তার জীবন চলতো।
১৯৭৭ কিংবা ৭৮ সালের কথা। সংসারেও অভাব অনটন ছিল। এতে বাকের তার বড় ছেলে আলমকে ভিক্ষা করার জন্য সেলিমের সঙ্গে পাঠিয়ে দেয়। আলমের বয়স তখন ৬ বছরের মতো ছিল। সেলিম তখন বরিশাল ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভিক্ষা করতো। তার সঙ্গী ছিল ভাতিজা আলম। এদিকে সেলিম এখনো জীবিত ও গ্রামের বাড়ি রামগঞ্জেই রয়েছে। কিন্তু আলমের দেখা আর কেউ পায়নি। তার বাবা বাকের ও মা রওশন এখনো ছেলের পথ চেয়ে বসে আছে। আর সেই ছেলেকে নিয়েই ভাই সেলিমের সঙ্গে বাকেরের ৩৫ বছর ধরে দ্বন্দ্ব লেগে আছে।
সেলিম বলছে, সংসারের অভাব অনটন দূরতেই আলমকে তার বাবা বাকের আমার সঙ্গে ভিক্ষা করতে দিয়েছিল। ভিক্ষা করতে গেলে মানুষ চাল দিতো। ওই চাল আলম চিবিয়ে খেত। এরমধ্যে যে বছর সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যা (১৯৮১ সাল) করা হয়েছে, ওই বছরই অসুস্থ হয়ে আলম মারা যায়। তখন তারা চট্টগ্রাম পাহাড়তলী এলাকায় ছিল। আলমের মৃত্যুর খবর বাড়িতেও পাঠানো হয়েছে।
কিন্তু মারা যাওয়ার পর আলমের পেট ফুলে উঠে। আর দুর্গন্ধও ছড়াচ্ছিল। এতে তার মরদেহ স্থানীয় একটি কবরস্থানে দাফন করা হয়। এর কিছুক্ষণ পরই আমার ভাই ও ভাবি সেখানে যায়। কিন্তু তারা আলমকে শেষ বারের মতো দেখতে পেলো না। ছেলে আলম বেঁচে আছে এবং ফিরে পাওয়ার আশায় বৃদ্ধ বাকের এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। খোনার-কবিরাজ, থানা পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন কোনটিই বাদ রাখেননি তিনি। ভাইকেও বলছেন তার ছেলেকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু যে যায় সে কি আর ফিরে আসে, এমনটি বুঝতে চাচ্ছেন না বাকের। বাকেরের দাবি, আলম মারা যায়নি। সেলিম তার ছেলেকে লুকিয়ে রেখেছে। আর যদি মারাও যায় লাশটি অন্তত তাদের হাতে তুলে দিতে হবে।
ছেলের মৃত্যুর বিষয়টি স্থানীয়রা বারবার তাকে বুঝালেও তিনি বুঝতে চাচ্ছেন না। যত টাকাই লাগুক ছেলেকে তার কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। প্রয়োজনে যেখানে তাকে কবর দেওয়া হয়েছে সেখান থেকে লাশ উত্তোলন করে তাকে দেখাতে হবে। আলমের দুঃখী মা রওশন বেগম বলেন, ৩-৪ বছর আগে আমি সেলিমের মেয়ের রাঙ্গামাটির বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানে সেলিমের মেয়ে জামাইয়ের দোকানে একজনকে আমি দেখেছি। যার চেহারা অবিকল আমার মতো। ওই আমার ছেলে। এখন তারা আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিচ্ছে না। কাউকে পাঠালে তারা তাকে লুকিয়ে পেলে। আমার ছেলে মারা যাইনি। আমার ছেলে জীবিত আছে।
বাড়ির মুরব্বি আমির হোসেন বলেন, আলমের মৃত্যু নিয়ে দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে বাকের ও সেলিমের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। তারা আত্মীয়-স্বজন আলমের মৃত্যু নিয়ে চট্টগ্রামেও গিয়েছিল। শুনেছি মৃত্যুর বিষয়টি সত্যি। তাহলে কিভাবে তাকে ফিরে পাবে বাকের ও রওশন। এটি বুঝালেও তার বুঝতে চাচ্ছে না। এরপরও তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে রাঙ্গামাটি সেলিমের মেয়ে বাড়িতে যাওয়ার কথা বলেছিলাম। সেখানে গিয়ে যাচাই বাছাই করার জন্য আলম সেখানে আছে কি না। তাও বাকের ও তার স্ত্রী রাজি হচ্ছে না। থানা পুলিশসহ স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারাও তাদেরকে অনেক বুঝিয়েছে। কিন্তু কোন লাভ হয় না। খোনার ও কবিরাজ বলে আলম বেঁচে আছে, তার ওপর ভরসা করেই তারা পড়ে রয়েছে।
এ ব্যাপারে সেলিম বলেন, আলমের মরদেহও এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না। সে কিভাবে আমার মেয়ের বাড়িতে আসবে ? ভাই-ভাবি আমার কথা বিশ^াস করছে না। আমি বলেছি তারা যদি আলমকে কোথাও দেখে, তাহলেও তাকে আনার জন্য আমার যেটুকু সম্পত্তি আছে, তা লিখে দিয়ে দেবো।
এ ব্যাপারে জানতে রামগঞ্জ পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কামরুল হাসান ফয়সাল মালের মোবাইল ফোনে চেষ্টা পাওয়া যায়নি।