থমথমে ঢাকা

আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশ কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকায় টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে। এরই মধ্যে সমাবেশ এলাকায় সংঘর্ষে জড়িয়েছেন বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। সব মিলিয়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে রাজধানী ঢাকাজুড়ে।

আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশ কেন্দ্র করে আগে থেকেই সাধারণ মানুষের মধ্যে শঙ্কা দানা বাধে। ফলে সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলের রাস্তায় ব্যক্তিগত ও গণপরিবহনের চলাচল বেশ কম দেখা যায়। কাকরাইল, পল্টন, মতিঝিল, গুলিস্তান, শাহবাগ বাদে রাজধানীর অন্য এলাকার রাস্তা প্রায় ফাঁকা দেখা যায়। রাস্তায় পরিবহনের সংখ্যা যেমন কম, তেমনি মানুষের চলাচলও কম।

বিএনপির সমাবেশ ঘিরে গতকাল শুক্রবার বিকেল থেকেই নয়াপল্টনে জড়ো হতে থাকেন দলটির নেতাকর্মীরা। অপরদিকে সমাবেশের অনুমতি না পেলেও শনিবার সকাল থেকেই মতিঝিল এলাকায় জড় হতে থাকেন জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা। ফলে শনিবার সকাল থেকেই রাজধানীতে এক ধরনের উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

 

এর মধ্যেই বেলা ১১টার দিকে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের সামনে একটি বাস ভাঙচুর করা হয়। একই সময়ে কাকরাইলের হেয়ার রোডে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) এবং প্রধান বিচারপতির বাসভবনের বিপরীতে দুটি পিকআপ ভ্যান ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। কাকরাইল মোড়ে বৈশাখী পরিবহনের একটি বাসসহ দুটি বাসও ভাঙচুর করা হয়।

 

এরপর থেকেই এক প্রকার রণক্ষেত্রে পরিণত হয় কাকরাইল এলাকা। পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার মধ্যে বেশ কয়েক স্থানে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। বিএনপি কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে পুলিশ। বেলা ১১টার পরপরই শুরু হওয়া সংঘর্ষ এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত (বিকেল ৩টা ৫৬ মিনিট) চলছিল।

এদিকে সংঘর্ষ চলার মধ্যেই রোববার (২৯ অক্টোবর) সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে বিএনপি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হরতালের ঘোষণা দেন। দলটির মিডিয়া সেলের ফেসবুক পেজেও এ ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

এদিন রাজধানীর মিরপুর, ফার্মগেট, শ্যামলী, মহাখালী, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রাস্তায় পরিবহনের সংখ্যা বেশ কম। মানুষের চলাচলও কম। বেশিরভাগ এলাকার রাস্তা প্রায় ফাঁকা। তবে মোড়ে মোড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অবস্থান নিতে দেখা গেছে।

রামপুরা থেকে মিরপুর-১০ এ যাওয়া সাইদুর রহমান নামের একজন বলেন, জরুরি কাজ থাকায় রামপুরা থেকে মিরপুর এসেছি। কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, কাজীপাড়া হয়ে মিরপুর-১০ নম্বরে এসেছি। কোথাও রাস্তায় কোনো যানজট নেই। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা খুব কম। ঢাকার রাস্তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সবার মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। জরুরি কাজ না থাকলে আজ বাসা থেকে বের হতাম না।

 

একই কথা বলেন যাত্রাবাড়ী থেকে ধানমন্ডি আসা মো. আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমার বড় ভাই অসুস্থ। তাই যাত্রাবাড়ীর বাসা থেকে ধানমন্ডি এসেছি। রাস্তায় আসার পথেই শুনতে পারলাম কাকরাইলে মারামারি হয়েছে। এখন বাসায় ঠিকমতো পৌঁছাতে পরবো কি না জানি না।

তিনি বলেন, আমরা কোনো সংঘাত চাই না। আমরা চাই রাজনৈতিক দলগুলো শান্তিপূর্ণভাবে তাদের কর্মসূচি পালন করুক। রাজনৈতিক দলগুলো সংঘাতে জড়ালে তা কারও জন্য ভালো নয়। দেশের জন্যও ভালো নয়। আমরা সাধারণ মানুষ চাই পরিস্থিতি শান্ত থাকুক।

এদিকে কাকরাইল ও পল্টনেও বিএনপি ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ চলার মধ্যেই রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে আগুন দিয়েছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে জাগো নিউজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন।

ফায়ার সার্ভিসের ডিউটি অফিসার রাফি আল ফারুক জানান, কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে আগুনের ঘটনায় দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে।

এদিকে সংঘর্ষে একজন পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বিজয়নগরে আওয়ামী লীগ-বিএনপির সংঘর্ষে পুলিশ, সাংবাদিকসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। অঞ্চলটিতে পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করছে। বিজয়নগর থেকে ধাওয়া দিচ্ছে বিএনপি, জবাবে পল্টন মোড় থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা লাঠিসোঁটা ও ইটপাটকেল নিয়ে ধাওয়া দিচ্ছে।

সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারের কাছে কথা হয় মো. আশরাফুল ইসলাম নামের একজনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি সেগুনবাগিচায়ই থাকি। আওয়ামী লীগ, বিএনপির সমাবেশ নিয়ে গতকাল থেকেই আতঙ্কে ছিলাম। আজ দুই দল সত্যি সত্যি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। আমার চোখের সামনেই কয়েকজনকে বেধড়ক পেটাতে দেখেছি।

তিনি বলেন, পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে এখন সেগুনবাগিচা থেকে কোনো দিকে যাওয়ার উপায় নেই। আমরা খুব আতঙ্কের মধ্যে আছি। আমরা এ ধরনের সংঘর্ষ চাই না। আমরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চাই।

শাহবাগ অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, শাহবাগ মোড় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকের রাস্তায় পরিবহন পার্কিং করায় রাস্তাটি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। শাহবাগ মোড় থেকে মৎস্য ভবন মোড় পর্যন্ত রাস্তায় অবস্থান নিয়েছেন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা।

শাহবাগ মোড়ে কথা হয় মিজানুর নামের এক আওয়ামী লীগ কর্মীর সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা রাস্তায় আছি। বিএনপি অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করলে তাদের উচিত জবাব দেওয়া হবে। কাউকে অরাজকতা সৃষ্টির সুযোগ দেওয়া হবে না।

এদিকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সমাবেশ কেন্দ্র করে উত্তপ্ত পরিস্থতি নিয়ন্ত্রণে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে। কাকরাইলে প্রধান বিচারপতির বাসভবন ঘিরে বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের পর ওই এলাকায় বিজিবি সদস্যরা টহল দেওয়া শুরু করেন। বেশ কয়েকটি গাড়ি নিয়ে বিজিবি সদস্যদের সেখানে অবস্থান নিতে দেখা গেছে।

বিকেল ৩টার দিকে বিজিবির সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, কাকরাইলের সংঘর্ষের পর সেখানে চার প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের সঙ্গে ছয় প্লাটুনি বিজিবি সদস্য আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। ১০ প্লাটুন বিজিবি সদস্যকে স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছে। প্রয়োজনে তারা রাস্তায় নামবে।

 

রাজধানীর কাকরাইলে আইডিবি ভবনে আগুন ও প্রধান বিচারপতির বাসভবনে বিএনপিকর্মীরা ভাঙচুর চালিয়েছেন বলে জানিয়েছেন ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিএনপি নেতাকর্মীরা কাকরাইলে আইডিইবি ভবনে আগুন দেন, চিফ জাস্টিজের ভবনে ভাঙচুর করেন। আমরা তাদের সরিয়ে দিয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘সমাবেশগুলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে করার কথা, ডিএমপি কমিশনারের কাছ থেকে তারা এমন শর্তেই অনুমতি নিয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে পুলিশের ওপর বিএনপি নেতাকর্মীরা প্রথমে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। এরপর আমরা তাদের সরিয়ে দেই।’

 

মতিঝিলে জামায়াতের মহাসমাবেশ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জামায়াত শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করলে আমরা কিছু বলছি না, কিন্তু সেখানেও তারা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছেন। আমরা সজাগ আছি, নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবো।’

আরও পড়ুন